পৃথিবীর অন্যসব মানুষের তুলনায় স্টিভ জবস বেঁচে ছিলেন কম সময়। মাত্র ৫৬ বছর।
জবস পাল্টে দিয়েছেন মানবসভ্যতার তিনটি ‘C’—কীভাবে মানুষ ‘Connect’, ‘Communicate’ ও ‘Consume’ করে। অথচ টাকা-পয়সার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারেননি। আরেক স্টিভ, স্টিভ ওজনিয়াকের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাপল ইনকরপোরেট!
ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে পুরোনো দিনের মেইন ফ্রেম কম্পিউটার দেখা যায়। ঢাউস কম্পিউটারগুলো দেখলে বোঝা যায়, একসময় কম্পিউটার কেমন ছিল! আর এখন তো আমাদের পকেটেই কম্পিউটার থাকে! সাভারের পরমাণু শক্তি কমিশনে এই অঞ্চলের প্রথম কম্পিউটারটি বসানো হয়েছিল সেই ষাটের দশকে। সেটির আকার ছিল একটি কক্ষের সমান।
অ্যাপল কম্পিউটার শুরু করার পর স্টিভ জবসের কাজ ছিল বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে বেড়ানো। পলো আলটোতে জেরক্স কোম্পানির একটি গবেষণাগারে জবস প্রথম এমন একটা বস্তু দেখেন, যা এখন মাউস নামে পরিচিত। দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূর দেখতে পাওয়া মানুষটি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন, এই ছোট্ট যন্ত্র এবং এর সঙ্গে কম্পিউটারের পর্দায় ছবি দিতে পারলেই সাধারণ মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবে। সেটি ছিল ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের চিন্তা। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে পর্দায় ছবি আর মাউস নিয়ে ম্যাকের আবির্ভাবের পর থেকে পাল্টে গেছে কম্পিউটারের জগৎ।
সব মুদ্রারই অপর পিঠ থাকে। ১৯৮৫ সালে ছেড়ে দিতে হয় অ্যাপল। একটি রেখে অ্যাপলের সব শেয়ার বিক্রি করে দেন তিনি। হাতে ২০ কোটি ডলার নিয়ে শুরু করেন নতুন যাত্রা—নেক্সট নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার লক্ষ্য হলো নতুন প্রজন্মের অপারেটিং সিস্টেম বানানো। জবসের উদ্দেশ্য ছিল, কম্পিউটারকে নানা রকম অনুষঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা, যাতে মানুষে মানুষে সংযুক্তি আর যোগাযোগ হয় সহজসাধ্য এবং সর্বজনীন। সে সময় আকস্মিকভাবে তিনি যুক্ত হন পিকচার নামের একটি অ্যানিমেশন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। জবসের হাত ধরে পিকচার থেকে সূচিত হয় অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র। এখানে তাঁর ভূমিকা ছিল একজন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীর। কিন্তু তাঁর স্বভাবসুলভ গভীরে ঢোকার বৈশিষ্ট্যই পিকচারের কর্মীদের অনুপ্রাণিত করে অনেকখানি। সে কারণে টয় স্টোরির গল্প শুধু গল্পই থাকে না, হয়ে ওঠে চলচ্চিত্রের বাঁকবদলের ক্ষণ।
অন্যদিকে নেক্সটের ফলাফল নিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রবলভাবে অ্যাপলে ফিরে আসেন জবস। শুরু হয় অ্যাপলের নবযাত্রা। আইম্যাক, আইপড, আইফোন কিংবা আইপ্যাড—সবটাতেই আমরা জবসের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। প্রথমটি হলো অতৃপ্তি! জবস সব সময় একটি সম্পূর্ণ পণ্য তৈরি করতে চান। শুরু থেকে জবসের গভীরে ঢোকার অভ্যাস ছিল। সেটিই পূর্ণতা পায় দ্বিতীয়বার অ্যাপলে এসে।
জবসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল—ব্যবহারকারীর হাত আর চোখ দিয়ে পণ্যকে বিচার করা। এ কারণে সব ধরনের নতুন পণ্য তিনি ব্যবহার করতেন। ভাবতেন, কীভাবে বিষয়গুলো আরও সহজ করা যায়। আইফোনে যদি কোনো সুইচ না থাকত, তাহলে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কিন্তু প্রকৌশলীরা তাঁকে বুঝিয়েছেন, কমপক্ষে একটি সুইচ বা বাটন থাকা অপরিহার্য।
অ্যাপল স্টোর চালুর পর ইকোনমিস্ট পত্রিকায় শিরোনাম করে, ‘দুঃখিত স্টিভ। তোমার ম্যাজিক এখানে কাজে লাগবে না।’ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানোয় স্টিভ ম্যাজিক অনেক বেশি মাইলেজ দিয়েছে অ্যাপলকে। গ্যারেজ থেকে উঠে আসা অ্যাপল ইনকরপোরেটেড বাজার মূলধন এখন ইন্টেল আর মাইক্রোসফটের সম্মিলিত বাজার মূলধনের চেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাপী অ্যাপলের রয়েছে কয়েক লাখ কর্মী। কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা, অ্যাপল তার মিউজিক স্টোরের মাধ্যমে বিশ্বের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী এখন নিজেদের দিন বদলের রাস্তা খুঁজে নিচ্ছেন।
স্টিভ জবসের জন্ম না হলে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দাদের অনেকেরই কিন্তু কম্পিউটার ব্যবহার করা সম্ভব হতো না!