ভোরের কাগজ : মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩:
আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহ থেকে : স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪০ বছরে ঝিনাইদহের ইতিহাসে চরমপন্থী নেতা, ক্যাডার ও সন্ত্রাসীদের জীবনের শেষ পরিণতি হয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যু, কারো এ পর্যন্ত স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। এদের জীবনের করুণ পরিণতি হয় খেজুরের পাটি বা চাটাইয়ে জড়িয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফেরা। অনেকেরই দাফন-কাফন পর্যন্ত হয় না। প্রতিপক্ষের হাতেই বেশি খুন হয় এরা। এ পর্যন্ত ঝিনাইদহে প্রতিপক্ষ ও দলীয় কোন্দলে দেড় সহস্রাধিক চরমপন্থী খুন হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধেও চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা নিহত হচ্ছে। দীর্ঘ ৪০ বছরে চরমপন্থী দলগুলোর শীর্ষ নেতা ক্যাডারদের দিনলিপি পর্যালোচনায় দেখা যায়, অপঘাতে মৃত্যু তাদের সর্বক্ষণ পিছু তাড়া করে। শুধু ঝিনাইদহ নয় কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা বিভাগের ১০ জেলার সব চরমপন্থীরই পরিণতি একই ধরনের।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিগত ৪০ বছরে ঝিনাইদহ জেলায় অনেক বাঘা বাঘা চরমপন্থী ক্যাডারের উত্থান ঘটেছে। প্রতিপক্ষ চরমপন্থীর হাতে, নিজ দলীয় ক্যাডারদের বিশ্বাসঘাতকতায় ও পুলিশের গুলিতে লাশ হয়ে খেজুরের পাটি, চাটাই বা পলিথিনে পেঁচিয়ে বাড়ি ফিরছে তারা। স্বাধীনতার আগে থেকেই এ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা শুরু হয়। আর এই হত্যার রাজনীতির প্রথম শিকার হন কালীগঞ্জের চাঁদ আলী চেয়ারম্যান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঝিনাইদহে একের পর এক গোপন চরমপন্থী দলের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। চলতে থাকে মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতা। ১৯৭২ সালে প্রথম আবির্ভাব ঘটে গোপন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল)। এ দলটি মাওবাদী ও শ্রেণীশত্রু খতমের আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। ঝিনাইদহ সদর, শৈলকূপা, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও হরিণাকু-ু উপজেলায় এদের ব্যাপক আধিপত্য ছিল। এরা বিভিন্ন সময় পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে তাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হতো। সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে চাল, গম লুট করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে তাদের পক্ষে রাখার চেষ্টা করতো। যার ফলে অল্পদিনের মধ্যে তারা ব্যাপক আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত নকশাল নেতা চারু মজুমদারের অনুসারী হওয়ায় এ দলটি ‘নকশাল দল’ নামে এ জেলায় পরিচিতি পায়।
১৯৭৩ সালে জাসদ তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড সেল গণবাহিনী গঠন করে। গণবাহিনীর দাপট ছিল মাগুরা ও চুয়াডাঙ্গা জেলা এবং ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকু-ু, শৈলকূপা উপজেলা ও ঝিনাইদহ সদরের হরিশপুর, পোড়াহাটি ও হলিধানি ইউনিয়নে। ১৯৭৪ সালে গণবাহিনী হরিণাকু-ু থানা লুট করে। ’৭৫ সালে লুট করে শৈলকূপা উপজেলার লাঙ্গলবাঁধ পুলিশ ফাঁড়ি। এরপর থেকে এরা এসব এলাকায় ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি’ রাখে। এরা সংগঠনের বিস্তৃৃতি ঘটাতে থাকে গণবাহিনীর দখলীয় এলাকায়। তখন থেকেই শুরু হয় দলে দলে খুন আর পাল্টা খুনের প্রতিযোগিতা। একদল অন্যদলকে আয়ত্তে পেলেই তাদের নেতা বা ক্যাডারদের হত্যা করতে থাকে। যেন সাপে নেউলে সম্পর্ক। পাশাপাশি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি শ্রেণীশত্রু আখ্যা দিয়ে গ্রামের জোতদার ও পুলিশের সোর্সকে হত্যা করতে থাকে।
১৯৭৫ সাল থেকে ’৮১ সালের মধ্যে গণবাহিনী ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় ৫০০ নেতা বা ক্যাডার খুন হয়। ’৮০-এর দশকের শুরুতে দুর্বার গতিতে বরিশাল, ফরিদপুর ও মাগুরা হয়ে সর্বহারা পার্টি এগিয়ে আসে ঝিনাইদহের দিকে। শুরু হয়ে যায় গণবাহিনী ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এলাকা দখলের যুদ্ধ। অল্প দিনের মধ্যেই সর্বহারা পার্টি আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ও গণবাহিনীর অসংখ্য নেতা ও ক্যাডার খুন হয় এদের হাতে। ১৯৮৭ সালে ঝিনাইদহ সদরের কংশী মাঠে সর্বহারা পার্টির সঙ্গে গণবাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে ৭ গণবাহিনী ক্যাডার নিহত হয় যা ওই এলাকায় সেভেন মার্ডার হিসেবে পরিচিতি পায়। বরিশাল থেকে আসা দলনেতা রাজিবকে ইটভাটায় পুড়িয়ে হত্যা করে অস্ত্র ভা-ার দখল করে নেয় তারই দলীয় ক্যাডাররা। পরে এই দলের ওপর বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি আঘাত হানে এবং তাদের আধিপত্য খর্ব করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বর্তমানে এ জেলায় সর্বহারা পার্টির কোনো অস্তিত্ব নেই।
’৯০-এর দশকের শুরুতে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আবির্ভাব ঘটে। হরিণাকু-ুর টিপু দলের মুকুটহীন সম্রাট হয়। এই দলের দাপটে বাঘে-ছাগলে একঘাটে পানি খায়। টিপু সঙ্গী হিসেবে পায় চরমপন্থী ইছাকে। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ইছা। দলীয় ক্যাডাররা বিশ্বাসঘাতকতা করে টিপু ও তার ৩ সঙ্গীকে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার এক বিলের মাঝে জীবন্ত কবর দেয়। শেষ হয় টিপু অধ্যায়। দাপট বেড়ে যায় বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির। সম্রাজ্য দখল করে শৈলকূপার শহীদুল ইসলাম লাল, যার কথাই ছিল আইন। সে এ জেলার নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং শেষে ঝিনাইদহে ফেরার পথে বিসিক শিল্প নগরীর পাশে মাইক্রো থেকে নামিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। শহীদুল ইসলাম লাল হত্যার পরবর্তী ঘটনায় রাব্বুল জাহাঙ্গীরসহ আরো ৭/৮ জনকে হত্যা করা হয়। শেষ হয় শহীদ লাল অধ্যায়।
১৯৯৭ সালের দিকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ তাত্ত্বিক নেতা ঝিনাইদহের মীর ইলিয়াস হোসেন দিলিপের নেতৃত্বে গঠন করা হয় শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন। দলের সামরিক শাখার নাম দেয়া হয় গণমুক্তি ফৌজ। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির বেশিরভাগ নেতা ক্যাডার গণমুক্তিফৌজে যোগ দেয়। তারা আঘাত হানতে থাকে বিপ্লবী ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির ওপর। এই আন্ডার গ্রাউন্ড যুদ্ধে উভয় দলের প্রায় ২০০ নেতাকর্মী খুন হয়।
১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাধারণ ক্ষমার সুযোগে আত্মসমর্পণ শুরু হয়। ওই সময় গণমুক্তি ফৌজ গণবাহিনীর ক্যাডাররা ভাঙাচুরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। অবশ্য এ সময় বিপ্লবী ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি আত্মসমর্পণে সাড়া দেয়নি। গুলিতে নিহত হয় মীর ইলিয়াস হোসেন দিলিপ।
২০০০ সালের দিকে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তৎপর হয়ে ওঠে এ জেলায়। সম্প্রতি দলটি ভেঙে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), (এমএল লাল পতাকা), (এমএল জনযুদ্ধ) ও (এমএল যোদ্ধা) এই ৪ ভাগে বিভক্ত হয়েছে। সামরিক শক্তি এবং হত্যার দিক থেকে আবদুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপনের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল জনযুদ্ধ) তখন শীর্ষে ছিল। তারা মানুষ খুনের পর পত্রপত্রিকায় ফ্যাক্সের মাধ্যমে দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। এমনকি মারার আগে ঘোষণা দিয়েও মানুষ খুন করা হতো। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভয়াবহ চরমপন্থী সংগঠন ‘জনযুদ্ধ’ নামের এই দলটির প্রধান ঝিনাইদহের দাদা তপন ওরফে আব্দুর রশিদ মালিথা ও তার ভাই আকাশ গত বছর কুষ্টিয়ায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর থেমে গেছে সেই খুনের ভয়াবহতা। অব্যাহত অভিযানে দলটি এখন বিপর্যয়ের মুখে।
একদিল বাহিনী প্রধান একদিল কুষ্টিয়ায় ক্রসফায়ারে নিহত হয়। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) নেতা কোর্ট চাঁদপুরের টুটুল ডাক্তারও নিহত হয়েছে বন্দুকযুদ্ধে। মেহেরপুরের গাংনী এলাকায় চরমপন্থী নেতা রনি বিশ্বাস গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। এ পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে চরমপন্থী দলগুলোর প্রায় ৪০০ নেতা-ক্যাডার ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। এছাড়া গত ৯ বছরে খুন হয়েছে বিভিন্ন চরমপন্থী দলের প্রায় ৪০০ ক্যাডার ও নেতা। তবে চরমপন্থীদের অস্ত্র ভা-ারের ভালো ভালো অস্ত্রগুলো এখনো রয়ে গেছে।
গত ৪০ বছরে ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আন্ডার ওয়ার্ল্ডে রক্তের মাধ্যমে যাদের উত্থান ঘটেছে রক্তের মাধ্যমেই তাদের পতন হতে দেখা গেছে। গোপন দলের হাতে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে যতো লোক খুন হয়েছে তাদের বেশিরভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চরমপন্থী দলের সঙ্গে জড়িত ছিল। খুনের পর পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে যে, সে চরমপন্থী দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। তবে এদের বিরোধিতা করায় বা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করার জন্যও অনেকে খুন হয়।
দীর্ঘদিন ধরে আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনীতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যে যতো বেশি মানুষ খুনে পারদর্শী তার নাম-ডাক ততো ছড়িয়ে পড়ে। লোকে আতঙ্কিত হয়। অনেকে দিনমজুর থেকে শীর্ষ ক্যাডারে আসীন হয়। প্রতাপশালী ক্যাডারও একদিন খুন হয়ে যায়। চরমপন্থী ক্যাডার খুন হলে মানুষ দুঃখ করে না। অনেকের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়।
বর্তমান আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই। অস্ত্র যার ক্ষমতা তার। খুন আর রক্তের মাধ্যমে যাদের উত্থান-দাপট, রক্তের মাধ্যমেই তাদের জীবনের শেষ পরিণতি ঘটে।
(Source: Bhorer Kagoj) (Link: http://www.bhorerkagoj.net/new/blog/2013/02/12/103241.php)
|